গ্রামবাসীর ভাগ্য বদলের কারিগর সোলায়মান

প্রকাশঃ জানুয়ারি ৩১, ২০১৫ সময়ঃ ৬:৪৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৬:৪৫ অপরাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডটকম:

download (4)মেনানগর । রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার নিচু প্রত্যন্ত এলাকার একটি। এক যুগ আগেও এ গ্রামের বাসিন্দারা ছিল অভাবী। শুধু কার্তিকের মঙ্গা নয়, ফসলাদি ভালো হতো না বলে বারো মাস অভাব লেগেই থাকত। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই।

ধানক্ষেতের পানিতে মাছ চাষ, গর্ত ও পুকুরে মাছের সঙ্গে হাঁস পালন ও জমির আইলে সুপারিগাছ লাগিয়ে এই গ্রামের মানুষ ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। এ ছাড়া বসতভিটার পরিত্যক্ত জমিতে চলছে সবজির চাষ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পালন করা হচ্ছে হাঁস, মুরগি, কবুতর, ছাগল ও গাভি। এভাবে ওই গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত দুই শত পরিবারের বেশির ভাগেরই অবস্থা আজ সচ্ছল।

আর গ্রামবাসীর এই ভাগ্য বদলের কারিগর হলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলার হাড়িয়ালকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। নাম তাঁর সোলায়মান আলী। ১২ বছর ধরে গ্রামবাসীকে তিনি শেখাচ্ছেন চাষবাস ও পশুপাখি পালনের নতুন কৌশল।

সোলায়মান জানান, তাঁদের সামান্য কিছু জমি ছিল। অন্যের বাড়িতে জায়গির থেকে ১৯৮৫ সালে তিনি স্নাতক পাস করেন। তাঁর মায়ের নাম সালমা ও বাবার নাম ইউসুফ। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। অনেক ঘোরাঘুরি করে চাকরি না পেয়ে ১৯৮৯ সালে নিজ উদ্যোগে তিনি মায়ের নামে থাকা একটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন। এতে কিছু লাভ হওয়ায় তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজনীয় টাকা সোলায়মানের হাতে ছিল না। বাবার কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে রাগ করে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। ওঠেন ফুফু মমতাজের বাড়িতে।

১৯৯০ সালে সোলায়মান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরি পেয়ে যান। টানা চার বছর চাকরি করে সেই অর্থ নিয়ে বাড়ি ফেরেন ১৯৯৪ সালে। সে বছরই একটি পুকুর খনন করে শুরু করেন মাছ ও হাঁসের চাষ। পাশাপাশি পুকুরপাড়ের চারদিকে পাঁচ শত সুপারির চারা রোপণ করেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন ধান চাষ।

কিন্তু সার, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের অগ্নিমূল্যের কারণে ধান চাষে তিনি লাভ করতে পারেননি। ১৯৯৮ সাল কেয়ারের মাঠকর্মী কামালের পরামর্শে তিনি এক একর জমির ধানখেতে মাছের চাষ করেন।

১৬ বছর ধরে হাঁস ও মাছ চাষ এবং সুপারিগাছ লাগিয়ে সোলায়মান আধা পাকা বাড়ি করেছেন। দামি কাঠের আসবাবপত্রে সাজিয়েছেন ঘর। কিনেছেন চার একর জমি। দুই মেয়েকে মাধ্যমিক (এসএসসি) পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। স্নাতক পাস করার পর চাকরি পেয়েছেন তাঁর দুই ছেলে লাবু ও লুৎফর। জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য বসিয়েছেন দুটি সেচপাম্প ও তিনটি শ্যালোমেশিন।

বাড়িতে রয়েছে কবুতর, গাভি, ছাগল। খামারে রয়েছে ৬০০টি হাঁস। জমির চারদিকে লাগিয়েছেন এক হাজার সুপারিগাছ। ২৫ শতক জমিতে লিচু ও ২৮ শতক জমিতে আম-কাঁঠালের বাগান করেছেন। এ বছর চার একর ধানখেতে মাছ চাষ করেছেন। তিনটি পুকুরের পানির ওপর খামার করে করছেন মাছ ও হাঁসের চাষ। এখন তাঁর খামারে দুজন কর্মচারী কাজ করছেন।২০০৪ সালে উপজেলা কৃষি বিভাগ সোলায়মানকে আদর্শ কৃষকের ও ২০০৫ সালে মৎস্য বিভাগ দক্ষ মৎস্যচাষির পুরস্কার দেয়।

সোলায়মান জানান, যে জমিতে কমপক্ষে তিন ইঞ্চি উচ্চতায় পানি রাখা সম্ভব তাতে মাছ চাষ করা যায়। প্রয়োজনীয় পানি আটকে রাখতে জমির চারদিকের আইলগুলো উঁচু করে দিতে হয়। ধান রোপণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে জমিতে মাছের পোনা ছাড়তে হয়। শিং, মাগুর, সরপুঁটি, তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, সিলভার কার্প চাষ করলে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভ হয়। মাছ চাষ করলে খেতে কীটনাশক দেওয়া যায় না। মাছই ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের ডিম খেয়ে ফেলে। যাঁরা খেতে দুবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করেন, এ ক্ষেত্রে একই পরিমাণ সার তিন দফায় জমিতে দিতে হয়।

তিনি বলেন, হাঁস দিয়ে ধানখেত নিড়ানির কৌশল তিনি উদ্ভাবন করেন ২০০৪ সালে। ওই বছর শ্রমিকের অভাবে বোরো ধানের ক্ষেতে আগাছা পরিষ্কার করতে পারছিলেন না। জমির আইলে বসে আগাছা পরিষ্কারের ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে দেখেন, তাঁর খামারের ২০-২৫টি হাঁস খাদ্য সংগ্রহে ধানখেতে নেমেছে। খাবার সংগ্রহের সময় হাঁসগুলো ঠোঁট ও পা দিয়ে খেতে বারবার আঘাত করছে। এতে আগাছাগুলো নষ্ট হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে উঠে দাঁড়ান সোলায়মান। ভাবেন কী করলে প্রতিদিন এ হাঁসগুলো ধানখেতে আসবে।

এ সময় তাঁর মাথায় আসে ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ধান ছিটিয়ে দেওয়ার কৌশল। ছিটানো ধান খাওয়ার সময় হাঁসগুলো ঠোঁট ও পা দিয়ে কাদায় বারবার আঘাত করবে। এতে নষ্ট হবে আগাছা ও আগাছার বীজ। তিনি ধানগাছ রোপণের ১৫ দিন পর প্রতি একরে ১০ কেজি ধান ইউরিয়ার সারের মতো ছিটিয়ে দেন। এভাবে সাত দিন পরপর তিনবার ধান ছিটিয়ে দিতে হবে।

সোলায়মান আশা করে বলেন, ‘আমি চাই দেশের সব মানুষই মাছের সঙ্গে হাঁস ও ধানখেতে মাছের চাষ করুক। এতে লাভ আছে, মনের আনন্দ আছে। কৃষিতে একটা বিপ্লব ঘটাতে পারলেই দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

প্রতিক্ষণ/এডি/মাসুদ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031
20G